লকডাউনের লক-আপ

মোছাঃ নাসিমা খাতুন

সহকারী পরিচালক

HSTTI, রাজশাহী

০৮/০৫/২০২১

 

করোনার থাবায় জীবন জীবকার দ্বন্দ্ব পড়ে গোটা পৃথিবীটা টাল মাতাল। বাংলাদেশ যেন বেশি টলছে। টলে একবার এদিকে হেলে যাচ্ছে আবার ওদিকে হেলে যাচ্ছে। পুর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব দিকেই হেলেদুলে দোল খাচ্ছে। কেউ হালছে জীবিকার খোঁজে, কেউ হালছে পুঁজির খোঁজে। উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্ত এই দুই দলই হেলেদুলে বেশি একাকার। এই দুই দলই দুলছে জীবন-জীবিকা আর পুঁজির নাগরদোলায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে কিছুটা আটকা পড়ে আছে ঘরের ভেতরে। তাল সামলানোর চেষ্টা করছে। 'বাকি সব কিছু উড়ে গেলেও পারফিউমটা রয়ে গেছে'র মতো করে। বাকি সব কিছু চলে গেলেও ধৈর্য্যটা রয়ে গেছে। আর এ সবরকিছু মধ্যে সমগ্র জাতি দুলছে জীবন- মরণের অনিশ্চয়তার দোলনায়।

এই জীবনমরণের চক্র থেকে দেশের জনগণকে বাঁচানোর জন্য সরকার দফায় দফায় লকডাউন দিচ্ছে। লকডাউন এই মূহুর্তে করোনা থেকে মানুষকে আক্রান্ত আর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর একটি শক্তিশালী কৌশল। কিন্তু সেই কৌশলে বাঁধ সাধছে উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা। যাদের অনেক  আছে, তাদের জীবনের চিন্তা নয়, জীবিকা চিন্তাও নয়, বাণিজ্যিক চিন্তা। আর যাদের কিছুই নেই মানে নিম্নবিত্ত, তাদের তো এমনিতেই কিছু নেই। তাদের শুধু পেটের ক্ষুধা। জীবনের তোয়াক্কা যেন হাওয়াই মিঠাই। খাইলেও নাই, না খাইলেও নাই।

সরকার করোনার প্রকোপ থেকে জাতিকে উদ্ধার করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে বেঁধে লকডাউন দিচ্ছে। সবাইকে ঘরবন্দি হয়ে করোনাকে হারানোর লড়াইয়ে। কিন্তু দরিদ্র জনগণের খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তারা বেড়িয়ে পড়ছে রাজপথে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করেছে নিষিদ্ধ চলাফেরাকে আটকাতে। এক দিকে আটকাচ্ছে তো অন্য দিক দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। অলিগলি পথ বেয়ে আর কি। এদিকে কিছু অফিস-আদালত, জরুরী সেবা, স্বাস্থ্যসেবাসহ কয়েক ধরণের অফিস ও কর্মীবাহীনিকে বিধি-নিষেধের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। তাদেরও তো গন্তব্যে যাওয়া দরকার। সবার গন্তব্য তো আবার পায়ে হাঁটার পথও নয়। বাধ্য হয়ে রিক্সা হোক, অটো হোক, সিএনজি হোক- উঠতে হয়েছে।  গরীবদের কিছুটা আয়ের সুযোগ করে দিয়ে লকডাউন গুঁটি গুঁটি পায়ে এভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল। এভাবে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লকডাউন প্রথমবার কিছুটা হোঁচটের মুখে।

লকডাউনের বয়স যখন কয়েকদিন, সেই পর্যায়ে ব্যবসায়ী শ্রেণি গণিত বই নিয়ে লাভ-লসের চ্যাপ্টারের অঙ্ক কষতে বসল। সরকার যখন কষছে জীবন আর মরণের হিসাব, তখন ব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের পুঁজির লাভের শতকরা হারের  ফলাফলের বের করতে ব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথের কথাটা মিথ্যা হবে কেন, 'এ জগতে হায়, সেই বেশি, চায় যার আছে ভুরি ভুরি।' শিল্পপতি, ব্যবসায়ী শ্রেণি, ধনিক শ্রেণি, বণিক শ্রেণি এরা কি কিছুদিন দেশের মানুষদের জীবনের কথা ভেবে আয়-ব্যয়ের হিসাব বন্ধ রাখতে পারত না? স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা চালানো, দোকান চালানোর অঙ্গিকার করে সরকারের কাছে দোকান খোলার অনুমতি নিল। সরকার তাদের কথায় বিশ্বাস করে ব্যবসায়ের অনুমতি দিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এতো করে বলার পরেও আজ একশ বছর পার হলেও কেউ তাঁর কথা রাখতে আসেনি। কথা কোনদিন কেউ রাখেও না। দেশের দোকান মালিক, ব্যবসায়ি শ্রেণি সরকারকে কথা দিয়ে তারাও কেউ তাদের অঙ্গিকার অনুযায়ী ফলাফল দেখাতে পারেনি। লকডাউন কিছুটা বনসাই বনে গেল।

জনগণ হয়ত ভেবেছিল, লকডাউন মানে লক খুলে ডাউনে রাখা অর্থাৎ নিচে রাখা। মানে বন্ধ লক খুলে দেওয়া। আটকানো তালা খুলে দেওয়া। তবে সবাই যে সেটা মনে করেই লক খুলে দিচ্ছে তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ তো মনে হয় জেনে শুনেই খুলে দিচ্ছে। কেউ বুঝে খুলছে, কেউ না বুঝে খুলছে। কেউ প্রয়োজনে খুলছে, কেউ অপ্রয়োজনে খুলছে। কেউ ক্ষুধায় খুলছে, কেউ সুযোগে খুলছে। লক খুলে গরীব ঘুরছে খাদ্যের পিছনে, আর টাকাওয়ালা ঘুরছে টাকার পিছনে। আর হুজুগেরা ঘুরছে মোহের পিছনে। 

দেশের কিছু জনগণ তো পেটের ক্ষুধার জন্য এমনিতেই লকডাউনের মানে বুঝতে চায় না। অন্য দিকে দোকান-পাট, শপিংমল, মার্কেট খুলে দেওয়ায় কিছু সৌখিন জনগণ লকডাউনের শব্দার্থ ভুলে গেছে। তবে জনগণের আর দোষ দিয়ে আর লাভ কী? দোকান তো জনগণের জন্যই খোলা হয়েছে। দোকানে তো আর জীন-পরীরা কিনতে যাবে না।

বাঙালি আবার সৌখিন বেশি। যতটা না সৌখিন, তার থেকেও বেশি হুজুগে। সেখানে কোন বাঁধাবিঘ্নের খাওয়া নেই। সারাক্ষণ মিডিয়ায় বলা হচ্ছে জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, শারীরিক দূরত্ব মানছে না, গাদাগাদি করে দোকানে আসছে। আচ্ছা, জনগণ কি জানতে পারছে কোন বাড়ি থেকে কে কখন কেনাকাটার জন্য বাজারে বের হচ্ছে, যে তাই সিরিয়াল করে করে তারা বাড়ি থেকে বের হবে? সৌখিন বাঙালি যখন দোকানে যাবে তখন কে আগে যাবে, কে পরে যাবে তা কে ঠিক করে দেবে? বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা, তার এক পার্সেন্ট মানুষও যদি দোকানে আসে তাহলেও ভীড়ের যে পরিমাণ দাঁড়াবে তা কল্পনাতীত।

বাংলাদেশের আকার-আকৃতি লকডাউনের আগেও যা ছিল, এখনো তাই আছে। দোকানগুলোর আকার আকৃতিও আগের মতোই আছে। দোকানের জায়গা লকডাউনের আগে যা ছিল এখনো তাই-ই আছে। তাহলে সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জায়গা কি মঙল গ্রহ থেকে আসবে? সেটা তো সম্ভব নয়। মঙলগ্রহে নাসার পাঠানো পারসিভিয়ারেন্স রোভার বা মার্স 2020 নিজেই গলদঘর্ম মঙ্গলগ্রহে তার তথ্য সংগ্রহে। সে আবার বাংলাদেশের মাটিতে ওখান থেকে জায়গা নিয়ে আসবে কী করে? তাই বা হবার ছিল, তাই-ই হচ্ছে। মানুষ আগের ফর্মেটেই গাদাগাদি করে, ঠাসাঠাসি করে জীবনের তোয়াক্কা না করে আনন্দ-কেনায় মেতে উঠেছে। হয়ত ভাবছে, দেশ-বিদেশে যে হারে করোনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, বাঁচি কি না বাঁচি, তার থেকে মনের শখটা আগে মিটিয়ে নিই। বাঁচলে তো পরেও শখ মিটাতে পারব। কিন্তু মরলে তো আর পারবই না। তাই জীবন থাকতে থাকতেই শখ আহ্লাদ মিটিয়ে নেই। তাই হয়ত বাজারে কেনাকাটার এতো হল্লা পড়ে গেছে। পুজিপতি, দোকানদার, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মন্ত্রও সার্থক। এভাবেই লকডাউন ছোট হতে হতে বামুনের পর্যায়ে চলে গেছে। লকডাউনের চেহারা এখন বারান্দায় প্লাস্তিকের টবে ঝুলিয়ে রাখা বনসাই। মাঝে মঝে একটু করে পানি দিয়ে শব্দটাকে তাজা রাখা আরকি!

সবই যখন চলছে তখন গণপরিবহণ কেন বন্ধ থাকবে? তারও তো গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। এটাও তো গণতন্ত্রের মধ্যে পড়ে। তাই পরিবহণ মালিকদের দাবী, সব খোলা তো গাড়ি বন্ধ কেন? তারও অধিকার আছে স্বাধীনভাবে চলাফেরার। এটা তার মৌলিক অধিকার। শুরু হলো মিছিল, মিটিং, প্রদিবাদ সভা। মিছিল, মিটিংয়ের শক্তি চিরকালই বেশি। শক্তি আর যুক্তির লড়াইয়ে জিতে গিয়ে অন্তঃজেলায় বাসগুলি চলা শুরু করল। রাস্তায় খুড়িয়ে চলা লকডাউনের পা ভেঙে দিয়ে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় এখন তারাই প্রথম। উপরন্ত, অন্তঃজেলা বাসগুলি লকডাউনকে এখন জনগণের সাথে পোটলা করে নিজের জেলার শেষ সীমানায় পৌঁছেও দিয়ে আসবে। সেখান থেকে পরের জেলার বাস আবার তাকে আদর করে তার জেলার শেষ প্রান্তে রেখে আসবে। এভাবে লকডাউন সারা দেশব্যপী ঘুরে বেড়াবে। তার চেহারায় কলম দেওয়া গাছের চারার মতো ডালপালা গজাতে থাকবে। পরিবহণ মালিকগণ সরকারকে কথা দিয়েছিল, তারা নিজেরা এবং যাত্রীদের মাস্কসহ, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রী সেবা দিবে। কিন্তু প্রথম দিনই অনেক বাস তাদের ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। 'অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং তো জমা দেইনি'। কথা দিয়েছি, স্বভাব তো পরিবর্তন করিনি।  

লকডাউন এখন নিজের অস্তিত্বের অতীত ইতিহাস জানার জন্য মজিলা ফায়ারফক্সের আড্রেসবারে নিজের ওয়েবসাইট খুঁজে বেড়াচ্ছে। না পেয়ে গুগুল সার্চ বক্সেও সার্চ দিচ্ছে। কিন্তু সবখানেই No result found দেখাচ্ছে। সে এখন নিজের স্বকীয়তা ফিরে পাওয়ার জন্য অলিগলির নির্জন পথে পথে, দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বেড়াচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে এখন সে শুধুমাত্র খবরের কাগজে লিখিত ভার্সনে বানান করা চেহারা নিয়ে কোন রকমে টিকে আছে। আর মিডিয়ার খবর আর টকশোয়ের টকঝালের চটকায় আলুভর্তা হচ্ছে।

লকডাউনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছোট হতে হতে এখন তাকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হচ্ছে। আর এই সুযোগে করোনা ব্যাটা এখনো কিন্তু মজা লুটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট হচ্ছে আবার একটু করে বড়ও হচ্ছে। লকডাউন বনসাই হতে থাকলে করোনার দেহ হৃষ্টপুষ্ট হবে নাকি নির্ভীক জনগণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাবে হবে সেটা সময় বলে দেবে। তবে হুজুগে বাঙালির হুজুগে চেহারাটা করোনা আর লকডাউন না এলে এতোটা চেনা যেতো না।

করোনা নিয়েও তো সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান রকমের সঙ্গা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ আছে যারা করোনাকে ভয়ই পায় না। কেউ কেউ তো করোনাকে বিশ্বাসই করে না। কেউ ভাবে, এটা বড়লোকের অসুখ। কেউ ভাবে, এটা শহরের অসুখ। কেউ ভাবে, এটা বিদেশীদের অসুখ। কেউ ভাবে, এটা পাপীদের অসুখ। কেউ বলে, মরণ থাকলে মরব। কেউ আবার ভাবে, করোনা আবার কী? এটা খায় না গাঁয়ে মাখে! করোনাকে নানান মানুষ নানান অংশে বিভক্ত করে বিভিন্ন সেক্টরে ঠাঁই দিয়েছে। কত কিসিমের বাঙালি। এদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ তো লকডাউনকে ছুটিতে রুপান্তর করে লকডাউনকে লক আপে রেখে দলে দলে চিল্লায় যাওয়ার মতো করে বাড়ির দিকে ছুট দিয়েছিল। যেন কোন এক হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছে, আর দলে দলে মানুষ সেই বাঁশির সুরে হিপ্নোটাইসের মতো নেশায় বুঁদ হয়ে ছুটে চলেছে একজন আরেকজনের ঘাড়ে চরে অজানা প্রান্তে।

মাঝখানে পুলিশ ভাইদের পাহারায় লকডাউন কয়েকদিন তাও কোন রকমে বড় রাস্তাগুলিতে সুখে শান্তিতে সংসার করতে পেরেছিল। এরা আবার নিরিবিলিতে বেশিদিন বাঁচে। জনসমাগমে এদের আয়ু কমে আসে। শিশিরের মতো। রোদ উঠলেই মৃত্যু। লকডাউনও মানুষ দেখলেই হার্টফেল করে, কোমায় চলে যায়। 

রাস্তাগুলি এখন লকডাউনের বিপরীত শব্দের দখলে, সারাদিন গর্জন করে ধমকাচ্ছে লকডাউনকে। দাঁত কেলিয়ে ভেংচি কাটছে। হাজার হাজার গাড়ির হর্নে নির্জীব লকডাউন চমকে চমকে উঠছে। আগাবে না পিছাবে বুঝতে পারছে না। ভয়ে ভয়ে ডিকশনারির পাতা থেকেও লকডাউন শব্দের মানে উধাও হয়ে গেছে। ভাবছে ঘর সংসারের পাত্তারি গুটিয়ে বনবাসে গেলে কেমন। ওখানে মনে হয় কেউ ডিস্টার্ব করবে না। নিশ্চিন্তে সংসার করা যাবে। লক আপের দাপটে লকডাউন এখন লজ্জাবতী রমণী। লজ্জায় মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়েছে। সমস্ত দেহজুড়ে অপমানের জ্বালা।। মানুষের পায়ে পায়ে বিড়ালের মতো এখন হেঁটে বেড়াচ্ছে পথে পথে। এমনকি এখন সে রিক্সায়, অটোতে, সিএনজিতে, গাড়িতে গাড়িতে করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়দিন পর ঈদ করতে গ্রামে গ্রামেও চলে যাবে ঈদের সেমাই, পায়েস খেতে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়তে। সবার সাথে কোলাকুলিও করবে। সবার হাত ধরে মজা করে ঘুরে বেড়াবে দেশ জুড়ে। ঈদ শেষে আবার সবার গলাধরে ফিরেও আসবে নগরে-নগরে, শহরে- শহরে। ভালোই হয়েছে। পাগল বাঙালিদের জন্য লকডাউন তার নিজের দায়িত্ব পালনের হাত থেকে বেঁচে গেছে। তার দেহ সংকুচিত হতে হতে এখন সে সত্যিই বনসাই। সারা শরীরে পুষ্টিহীনতার চিহ্ন। দেখা যাক, এভাবে সে কতদিন বেঁচে থাকতে পারে। ভবিষ্যতই বলে দেবে সে জনগণের আর কোনো কাজে লাগবে কিনা?  

আহারে লকডাউন! করোনার খপ্পরে পড়ে বেচারি লকডাউনের অর্থই বদলে গেল। পৈত্রিক চেহারা হারিয়ে সে এখন রূপান্তরিত প্রজাতি। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সে যে আর কোন্‌ কাজে কোন্‌ অর্থে ব্যবহৃত হবে তা ভেবে সে নিজেই আতঙ্কিত। এতো অধঃপতনের জন্য শালার করোনাই দায়ী। ঐ শালা দুনিয়ায় না এলে তো আমাকে নিয়ে এতো টানা হেঁচড়াও হোত না, আমার নাম পরিচয়ও এতো শংকটে পড়ত না। ব্যাটা করোনাকে ধরতে পারলে লবন পানিতে গুলে গিলে খেয়ে ফেলতাম। ব্যাটা তুমি শুধু মানুষের পিছনেই লাগনি, আমারো বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছ। ব্যাটা তোর জন্য আমার বংশেরও জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে গেছে। 

এদিকে মাস্ক ব্যাচারি তো পড়েছে আরেক বিপদে। কেউ তো তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। কী মূল্য নিয়ে বেঁচে থাকবে দুনিয়ার বুকে? অল্প কিছু লোক দয়া করে মুখের মধ্যে রাখছে বিপদে পড়ে। কেউ কিন্তু আদর চুমু খাওয়ার জন্য নয়। সিস্টেমটা কিন্তু কিছুটা মুখে জড়িয়ে চুমু খাওয়ার মতোই। কিন্তু কেউ এটা আদর করে মুখে জড়ায় না। বিপদে পড়েই জড়ায়। কেউ কেউ তো এটাকে মুখে ঠুসি পরে থাকার মতো বলে বিরক্ত হচ্ছে। তাদের ভাষায়, আমরা তো মানুষ, আমরা কেন মুখে ঠুসি পরব? ঠুসি তো পরবে গরু জাতি। যাই হোক, বিপদে পড়লে বিড়ালও গাছে উঠে। আমরাও বিপদে পড়েছি। আমাদেরও গাছে উঠতেই হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো সেটা বুঝতেই চায় না।

মাস্ক বেচারি অন্যের মুখ বন্ধ রাখতে গিয়ে নিজেই চিপায় পড়ে থাকছে। মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে গিয়ে নিজেরই মুখ বন্ধ হয়ে থাকছে। মুখে না পরে থুতনির নিচে চিপা গলির মধ্যে আটকিয়ে রাখছে। কেউ কেউ হ্যাঙ্গারে শার্ট ঝুলিয়ে রাখার মতো করে কানের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখছে। বেচারি মাস্ক- হাত, পা ছড়িয়ে বিছিয়ে প্রশস্ত হয়ে মুখের চারপাশে জীবনযাপন করবে, তা নয়, আটো সাটো হয়ে গলার নিচে, নাহয় কানের পাশে অবহেলায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। কোন রকমে থুতনীর নিচে অসহায়ের মতো লেপ্টে থাকতে হচ্ছে। কেউ কেউ তো আবার মাস্ক পছন্দই করে না। মুখেই তুলে না। যেন রুচিই হয় না। ওদিকে কেউ আবার একই মাস্কই দিনের পর দিন গলায় ঝুলিয়ে রাখে। ধোয়ও না, ফেলেও না। বেচারি মাস্ক নিজের গন্ধে নিজেই বিরক্ত।

আর শারীরিক দূরত্ব? সামাজিক দূরত্ব? বেশিরভাগ মানুষ তো এর মানেই বোঝে না। এটার তো আরো বেহাল দশা! এটা আবার কোন্‌ কিসিমের জিনিস? শরীরে শরীরে মাখামাখি, গলাগলি, কোলাকুলি। এ যেন 'আম গাছ জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন, মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন'এর আহ্ববান। বাজারে পথে পথে, দোকানে দোকানে মানুষের সুনামীর উপচে পড়া ঢেউ। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসিতে বাজার বেচারার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার থেকে লকডাউনের আগেই ভাল ছিল। একটু স্পেস পেত নিঃশ্বাস নেওয়ার। বাজারে দরকারি কাজে হঠাৎ কোনদিন ঢুকলে মনে হয় বিরাট আকারের কোন বাণিজ্য মেলায় ঢুকে পড়েছি। যতই দূরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, ততই অন্য লোকজন সেই ফাঁকা জায়গাটা দখল করে পারলে গায়ের উপর এসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আদিম সমাজ ব্যবস্থার সূত্র ভুলতে পারে না। যদি বিনয়ের সাথে বলা হয় "প্লিজ একটু দূরত্ব নিয়ে দাঁড়াবেন।" অমনি আশেপাশের জনকণ্ঠ একসাথে গর্জন করে উঠে, "এতো ভয় তো বাজারে এসেছেন কেন? গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকলেই পারেন।" "ভাই এটা শুধু আমার একার জন্য নয়, আপনাদের ভালোর জন্যও তো বলছি।" অমনি স্বমস্বরে হুংকার বেজে উঠে, "মরণ থাকলে মরব, আপনার কী তাতে?" বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দোকানদার, ক্রেতা মাস্ক ছাড়াই কেনা বেচা করছে। একটু ভয়ে ভয়ে বলার চেষ্টা করি, "ভাই মাস্কটা পরলে মনে হয় একটু ভাল হয়।" আর যাবে কোথায়? দোকানদার, ক্রেতা সকলে একজোট হয়ে পারলে লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে মারতে আসে। অতোগুলো লোকের সাথে একা কি শক্তিতে, যুক্তিতে পারা যায়? মার খাওয়ার থেকে পালিয়া আসা ভাল। অনেকদিন এ রকম জনকল্যাণের সুর শোনাতে গিয়ে বিপদের শিকার হয়েছি। তারপর থেকে কান ধরেছি, মানুষের উপকার আর করতে যাব না। বাবারে বাবা, এদেরকে বোঝায় সাধ্য কার? তার থেকে চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। বাঙালি নিজের মর্জিতে চলে। করোনা প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যার স্বাস্থ্যবিধি কিছুই মানে না। কিসের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা! বাঙালি নিজেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা। স্বাস্থ্যবিধির ডিপো।

বাঙালি এমনিতেই অনেক সাহসী জাতি। যে কোন দুর্যোগ, মহামারী, মহাপ্রলয়ে প্রাণপণে লড়ে টিকে থাকার জাতি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই নিরস্ত্র বাঙালি জাতিই শুধু সাহস আর অদম্য ইচ্ছা শক্তির দ্বারা একটি সুসংগঠিত জাতিকে পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করেছিল। দেশমাতাকে বাঁচানোর জন্য ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিল। বাঙালি প্রয়োজনে মরতে ভয় পায় না। তাই বলে অকারণ মৃত্যু! যে মৃত্যুর মাঝে কোন গর্ব নেই, কোন প্রাপ্তি নেই, বৃহত্তর স্বার্থ নেই, সে মৃত্যুর জন্য কেন মরিয়া হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব? এ তো পাগলামীর মৃত্যু ছাড়া আর কিছু না। মরার জন্য বাঙালি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। 'নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই' এর আত্মতৃপ্তিতে ভূগছে। সব মৃত্যুই তো আর আত্মত্যাগের মৃত্যু নয়। জন্ম-মৃত্যু আল্লাহ্‌র হাতে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে, মরার জন্য পা বাড়িয়ে থাকা! আল্লাহ্‌ই তো বলেছেন, জীবন বাঁচানো ফরজ। বাঁচার জন্য কি তাই মিনিমাম সুযোগটুকু কাজে লাগাবো না? তার জন্য তো টাকা পয়সাও তেমন খরচ করতে হচ্ছে না। শুধু একটু সচেতনতা, সতর্কতা আর কিছু কৌশল। অন্য কোন অসুখ হলে তো ঠিকই ডাক্তার, কবিরাজ, বদ্যির বাড়ি জান ছেড়ে দৌঁড়াই। পারলে জমি-জমা বেঁচে দেশ-বিদেশের ডাক্তারের ঘরে গিয়ে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়ে বসে থাকি। কিন্তু করোনার প্রতি কেন এতো উদাস উদাস ভাব? বিনা পয়সার, বিনা খরচের ব্যবস্থাপত্র কেন গ্রহণ করছি না?

আজব বাঙালি! করোনাকে গলাগলি ধরে কোলাকুলি করছি। করোনার সাথে উদারতার পরিচয় দিচ্ছি। বন্ধুর মতো ব্যবহার করে আবার বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছি। করোনা কিন্তু শুধু বুড়ো আঙুলই দেখাচ্ছে না। দশ আঙুল দিয়ে চেপে ধরছে ফুসফুসের দেহকে। তাতেও বাঙালি ভয় পাচ্ছে না। ঘরে যেন মনই বসে না। "ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।" মানুষ তাই শারীরিক দূরত্বের সূত্র ভেঙে সদলবল হওয়ার জন্য রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ছে। লকডাউনের হাত-পা ভেঙে নুলো করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা সমস্ত রাস্তা দখল করে নিয়েছে। ফাঁকা রাস্তাঘাট, বন্ধ দোকানপাট ছাড়া লকডাউনের প্রাণ বাঁচে না। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না। কিন্তু মানুষ তো তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না ঠিক মতো। এখন সে পঙ্গুত্ব বরণ করতে যাচ্ছে প্রায়।

এদিকে কিন্তু অনেক বাঙালিকে অফিস-আদালতের কাজের সময় দেখা যায়, সুযোগ পেলেই কাজে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার ধান্দা করে। প্রায়ই অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে ছুটি নিয়ে কর্মীদের রেষারেষিও হয়। অথচ সরকার যখন বেশিরভাগ অফিস কর্মীদেরকে সুযোগ দিয়েছে অফিসে না গিয়ে ঘরে থাকার, কিন্তু হুজুগে বাঙালির তখন আর ঘরে মন বসছে না। ঘর ছেড়ে ছূটে ছূটে রাস্তায় চলে আসছে। যেন পথই আমার ঠিকানা। এ পথ যেন শেষ না হয়......।

এদেশের মানুষ করোনা প্রতিরোধের আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান। বিধাতাও বোধহয় বাঙালিদের একটু বেশি ফেভার করে। স্বাস্থ্যবিধির এতো অনিয়মের মধ্যেও, এতো ঘন বসতির দেশেও বাঙালি ঠিকই টিকে থাকে। যদিও কিছু প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগ যদিও সুস্থ্য হয়ে উঠছে। তবে সুস্থ্য উঠাটাই কিন্তু চূড়ান্ত স্বস্থির ও আনন্দের বিষয় নয়। করোনা পরবর্তী বিভিন্ন জটিল সমস্যায় ভূগতে হয় তাদেরকে। এজন্য বৃহত্তর স্বার্থে সবাই যদি ক্ষুদ্র স্বার্থকে কিছু সময়ের জন্য ত্যাগ করি, তাহলে করোনা নামক এই মহামারীকে একেবারে নির্মূল করা যেতো। এটা যত বেশিদিন থাকবে, দেশ তত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হবে। দোকান মালিক, ফ্যাক্টরির মালিক, ক্রেতা বিক্রেতা, সাধারণ পথচারী সবাই যদি কিছুদিন নিজেদের লাভ-লস, পাওয়া-না পাওয়ার হিসেবগুলো খাতায় বন্ধ করে রাখত, পরবর্তীতে দেশ একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এলে ব্যবসা-বাণিজ্য, লাভ, আয়-রোজগার,আনন্দ সবই বহুগুনে ফেরত আসত।। বিশেষ করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দ্রুত ফেরত আনা যেত। সাময়িক লাভ যতই বেশি হোক না কেন, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির চেয়ে সেটা বেশি হতে পারে না। সে ক্ষতি দেশের প্রতিটি মানুষেরই ক্ষতি। একটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যত বেশি হুমকির মুখে পড়ে সেই দেশ তত বেশি পিছিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পাকিস্থানি হানাদারেরা যেমন এদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবি হত্যার কৌশল প্রয়োগ করেছিল। তারা প্রায় ১০০০ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করেছিল। তার মধ্যে  প্রায় ৯০০ জনই ছিল শিক্ষক। কারণ তারা জানত, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা মানে দেশকে ধ্বংস করা।

তাই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সকল সেক্টরকে চিরস্থায়ীভাবে সচল করার জন্য দেশের বর্তমান এই দুর্যোগের সময় উচ্চস্তর হতে নিম্নস্তরের সবাই যদি লকডাউনের সত্যিকারের মানে বুঝে লকডাউনকে সঠিক মর্যাদা দিয়ে চলতে পারি, সঠিক নিয়মে মাস্ক পরি, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলি, প্রয়োজন ছাড়া অহেতুক ঘর থেকে বাইরে  বের না হই, জীবনের প্রয়োজনগুলোকে কিছুদিনের জন্য একটু ছোট করে ফেলি, খেটে খাওয়া ও অসহায় মানুষদেরকে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান, দাতাগোষ্ঠী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, দল, মত, নির্বিশেষে সবাই খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে কিছুদিন তাদেরকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে বেশিদিন লাগবে না হয়ত আমাদের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে। তাতে আখেরে আমাদের সবারই লাভ। অন্ধকার দূর হয়ে আলো ফুটবেই ইনশাল্লাহ্‌। সবাই ভালো থাকবে, সুস্থ্য থাকবে, দেশ যাবে এগিয়ে।

 

লেখকঃ নাসিমা খাতুন

সহকারী পরিচালক

                HSTTI, রাজশাহী

 

Comments